Saturday, June 28, 2014

নীতা ও অন্যান্য

শামীম আখতার
নীতা আমার কাছে এক ধরনের মর্ষকামী চরিত্র। শক্তিপদ রাজগুরুর উপন্যাস থেকে নির্মিত ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারাম্ব চলচ্চিত্রটির নায়িকা। পৃথিবীর যাবতীয় কষ্ট, অপমান, মার খাওয়া চরিত্র নীতা। ছোটবেলায় যখন ছবিটি প্রথম দেখি, তখন আমার বয়স খুব বেশি হলে আট। সেই থেকে নীতা আমার মগজে প্রোথিত একটি বীজ, যখন কাঁদতে ইচ্ছে হয় কোনো অনির্ণীত, অজ্ঞাত কারণে, নীতাকে মনে করলেই চোখ ভিজে ওঠে। হৃদয় মুচড়ে কান্না ঠেলে ওঠে।
এটা কেবল আমার বেলায় নয়। আমি যত জনাকে ছবিটি দেখিয়েছি, এমন একজন নেই যে, চলচ্চিত্রটি শেষ হবার পর নিশ্চুপ, বিমূঢ় বসে থেকেছে। তবে কি নীতা নারী-পুরুষ উভয়েরই মধ্যে সঙ্গোপনে গোপনে বিরাজমান যে অপূর্ণতা, না পাওয়ার প্রতিরূপ বা প্রচ্ছায়া হয়ে দাঁড়ায়? সাত সকালে নীতা বেরিয়ে যায়। অফিসের উদ্দেশে। কাঁধে ঝোলা, কলকাতার কঠিন ফুটপাথের পাষাণ প্রস্তরে প্রখর রোদে নীতা হেঁটে যায় ছাতা মাথায়। চিরকালের সাধারণ মধ্যবিত্ত কেজো নারীর স্বরূপ। নীতারা দেশ বিভাগের শিকার। গোটা পরিবারটা পদ্মা পেরিয়ে এপারে এসে কলকাতার অদূরে কল্যাণিতে গজিয়ে ওঠা বাঙাল শরণার্থীদের কলোনিতে সপরিবারে থাকে। বাবা স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক। নীতার মা আর দশজন কোমলমতি মা নন। জীবন তাকে স্বার্থের অঙ্ক কষাটায় পারদর্শী করেছে। বড় ভাই ভাবুক গাইয়ে। গলা সাধায় মগ্ন সারাবেলা। যেমন ছোট ভাইটি মগ্ন খেলাধুলা ব্যায়াম, কলেজে পড়া নিয়ে। যেমন ছোটবোন গীতা, রমণীয়, আপনাতে হারা কস্তুরি মৃগ। যার যার বৃত্তে মগ্ন সবাই, নীতা নিমগ্ন এদের স্ব স্ব ইচ্ছা নিবৃত্তির চাহিদার যোগান দিতে। সে ধরেই নিয়েছে এর বাইরে আর কিছু হতে পারে না। নিতাকে সনৎ ভালোবাসে। নীতার স্বপ্ন সে উচ্চশিক্ষা নিয়ে একদিন স্বনামে পরিচিতি হবে। সুতরাং নিজের চাকরির পর টিউশনির টাকা থেকে সে সনৎকে দেয়। সবার ইচ্ছে পুরণ করে নিঃস্ব নীতা পূর্ণ হয়। সবার প্রাপ্তির তার প্রাপ্তি হয়ে ওঠে। তার অসীম দুর্বলতা বড় ভাইটিকে নিয়ে। বেকার, যাযাবর যুবক। জটিলতার সাত পাঁচ বোঝে না। সেই দাদা একদিন বড় গায়ক হবে এটা নীতার বিশ্বাস। বাড়িতে বড় ভাইটি অনাদৃত, অবজ্ঞার শিকার। নীতা তাই তার দু’ডানা মেলে আগলে রাখে দাদাকে। দাদাও জানে, এই বাড়িতে, সেখানে সে অপদার্থ বই আর কিছু নয়, সেখানে তার একমাত্র আশ্রয় এই বোনটি। সনৎ নীতাকে ভালোবাসে। অথবা বলা যায় নীতা সনৎকে ভালোবাসে। সনৎয়ের চিঠিতে বর্ণিত হয় নীতা। ‘তুমি যেন মেঘে ঢাকা এক তারা’। এই সনৎই গীতার উচ্ছলতা নিজের পুরুষ সত্তাকে অনুভব করে। আকৃষ্ট হয় গীতার প্রতি। এর মধ্যেই বাবা একদিন রাতে বাড়ি ফিরতে গিয়ে দুর্ঘটনায় সচলতা হারান। নীতার আয় মায়ের কাক্সিক্ষত উপার্জন। একমাত্র এবং এই সময়ই সব আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে সনৎ গীতাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। এতে আবার অক্ষম ক্ষোভ, মায়ের স্বস্তি, অন্তত তার উপার্জনক্ষম একমাত্র অবলম্বন নীতার হাত ছাড়া হবে না। একমাত্র দাদা বিষয়টিকে গ্রহণ করতে অক্ষম, সুতরাং প্রতিবাদ করে সে বাড়ি পরিত্যাগ করে। এর পরের অংশ আরও নির্মম। নীতার ছোট ভাইয়ের দুর্ঘটনায় হাত অকেজো হয়ে যাওয়া। সে ইতোমধ্যেই লেখাপড়া শিকেয় তুলে এক কারখানায় চাকরি নিয়েছিল। তার ওষুধপথ্য রক্ত জোগাড় করতে হিমশিম নীতা। অর্থের খোঁজে ছোট বোন গীতা সনৎয়ের ঘরে গিয়ে হাজির হয়। ঘোরের মধ্যে ছিল, সম্বিত ফিরে পায় গীতার বক্রোক্তির ধারে। হাসপাতালে ভাইকে দেখাশোনা করার ফাঁকেই ধরা পড়ে নীতার যক্ষ্মা হয়েছে। এই অবস্থাতেই সে অফিস করে এবং বাড়ির কোণের ঘরটায় স্বেচ্ছা নির্বাসনে বন্দি থাকে। ইতোমধ্যেই খবর আসে দাদা বম্বে বা মুম্বাইতে বিরাট গায়ক হয়েছে। সগৌরবে সে বাড়ি ফেরে। গোটা পরিবার তাকে ঘিরে উৎসবে মত্ত। ঘরের পর্দার ফাঁক দিয়ে পরিবারের এই দুর্লভ মিলন দৃশ্য অবলোকন করে নীতা। পৃথিবীতে অবাঞ্ছিতের জায়গা নেপথ্যেই চিরকাল। এত হৈচৈয়ের মধ্যে নীতার খোঁজ পড়ে। মা জানায় কি কারণে মেয়ে ওই ঘরে পড়ে থাকে। নিজের থালাবাসন নিজে হাতে ধোয়। দাদা সোৎসাহে উঠে যায়। বিছানায় শুয়ে নীতা কি যেন লুকোতে চায়। দাদা হুড়োহুড়ি করে, যেমনটি করতো আগে ‘খুকি… এই প্রেম করা হচ্ছে না…’। টেনে হাত থেকে রুমালটি ছাড়াতে গিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। রক্তমাখা। দাদার বিস্ফারিত চোখ। তাৎক্ষণিক বেরিয়ে যায়। খুকির টিবি হয়েছে, লেট স্টেজ রাতে ঝমঝম বৃষ্টি। তার ছাঁট আসছে জানালা গলে। নীতা মাথা তুলে দেখে। অদ্ভুত এক বেঁচে ওঠার প্রত্যাশা মাখা হাসি। কপালে হাত রাখে বাবা। ‘চলে যা… তোর নিঃশ্বাসে এখন বিষ… ওরা কেউ তোরে চায় না… তুই চলে যা।’ অদূরে রাখা কাপড়ের পুটলিটা দেখিয়ে অদ্ভুত এক যন্ত্রণাকাতর বাবা তার অবহেলিত সন্তানকে কেউ করুণা করুকÑ তাই পথ দেখান। বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পড়ে নীতা। মুখে হাসি। দুর্গা বিসর্জনের গান ব্যাকগ্রাউন্ডে। যেন এতদিনে মুক্তি তার। কিন্তু গেটের কাছে দাদার হাতে ধরা পড়ে যায়। হাত থেকে ছিটকে পড়ে কাচ বাঁধানো ফ্রেমে ছেলেবেলার দু’ভাই বোনের ছবিটা। এরপর শিলংয়ের স্যানাটরিয়াসে দাদা ফলের ঝুড়ি হাতে নীতাকে দেখতে এসেছে। নার্স সতর্ক করে। রোগী যেন উত্তেজিত না হয়। পাহাড়ের গায়ে পাথরের ওপর বসে নীতা। এক দৃষ্টিতে দেখছে তার প্রিয় পাহাড়। টিলা। জঙ্গল। দাদাকে দেখে খুশি হয়। ম্লান হাসি। হাতে ধরা কাগজটা উড়িয়ে দেয়। সনৎয়ের লেখা সেই চিঠি। দাদা গল্প করে। বাড়ির অবস্থা বদলে গেছে। মায়ের শখের দোতলা হয়েছে। গীতার ছেলেটা সারাদিন সিঁড়ি বেয়ে ওঠে-নামে। নীতা হঠাৎ আর্ত বলে ওঠে ‘দাদা, আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম’… দাদাকে আঁকড়ে ধরে, চিৎকার করে বলতে থাকে ‘দাদা আমি বাঁচতে চাই।’ নীতা বাঁচেনি। নীতারা বাঁচে না। বেঁচে থাকলেও মরে মরে বাঁচে। নীতা যখন বলেছিল আমি বাঁচতে চাই। আসলে কি বলতে চেয়েছিল সে? নীতা আসলে কি চেয়েছিল? এই প্রশ্নটি শ্বাশতÑ সত্য, অমোঘ নারী নিয়তির। উত্তর পাঠক দেবেন।
- See more at: http://anannya.com.bd/?p=659#sthash.h6mYEjeN.dpuf

No comments:

Post a Comment