Saturday, June 28, 2014

উপমহাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নারীর অনুকূলে কখনও ছিল না। বরং তাকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা চলেছে। ইতিহাসের নানা পর্যায়ে এই চেষ্টার প্রধান একটি অংশ রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার- লিখেছেন তুহিন ওয়াদুদ

বাংলা ভূখণ্ডে রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবহার নারীদের অবরুদ্ধ জীবনের ইতিহাস  অনেক পুরানো। ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন হবার চেষ্টা দেড় হাজার বছরের। ব্রিটিশরাও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর রাষ্ট্র নিরুপদ্রব রাখার জন্য তিন ধর্মের ত্রিমাত্রিক ব্যবহার শুরু করে। ব্রিটিশরা তাদের খ্রিস্টানপন্থী বাঙালিদের সংখ্যা বৃদ্ধির চেষ্টা করতে থাকে।
অন্যদিকে মুসলিম এবং হিন্দুদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে অখণ্ড বাঙালি শক্তিকে দুটি ভাগে বিভাজিত করে শাসন কার্যের কাল-পরিধি বাড়ায়। কাল-পরম্পরায় বাঙালি নারীসমাজ ছিল গৃহবাসী। গৃহের বাইরে তাদের চলাচল ছিল অত্যন্ত সীমিত। হিন্দু-মুসলিমনির্বিশেষে -অবস্থা বিরাজিত ছিল। ব্রিটিশ শাসনামল শুরু হওয়ার পর বাংলা ভূখণ্ডের যারা পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হতে থাকে তাদের দ্বারা এবং যারা পাশ্চাত্য জীবনাচরণকে মেনে নেন তাদের দ্বারা বাংলার নারীসমাজকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসার ব্যবস্থাসহ অন্য সকল বিষয়ে গৃহের বাইরে আনার একটি সামাজিক চেষ্টা চলতে থাকে।
সমাজের এই কুসংস্কার ভেঙে প্রগতিবাদী সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে সীমাহীন প্রতিবন্ধকতা নেমে আসে। তুলনামূলক সহজেই হিন্দুসমাজ নারীদের মুক্ত জীবনকে সমর্থন করলেও মুসলিম সমাজ সহজে তা গ্রহণ করে না। ফলে হিন্দু নারীরা এগিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনসহ অনেক সমাজ সংস্কারকের হাত ধরে বাংলার মুসলিম নারী প্রগতির পথ সম্প্রসারিত হয়
বাংলা ভূখণ্ডে রাষ্ট্রের বিকাশ, চিন্তা-চেতনার বিকাশ, রাষ্ট্রীয় দর্শনের বিকাশ সব কিছুই হয়েছে ধর্মকে অবলম্বন করে। ১৮৮৫ সালে যে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় তাও শেষ পর্যন্ত হিন্দুধর্মের স্বার্থ সংরক্ষণের বড় ভরসাস্থল বলে বিবেচিত হতে থাকে। নিজেদের অবস্থা ধরে রাখতে ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগ। এই দুটি সংগঠন ক্রমাগত নিজেদের অবস্থানে শক্ত হতে থাকে। উভয় সংগঠনের যখন কেউই চায়নি ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে থাকুক তখন তারা বিতাড়িত হতে বাধ্য হয়। কিন্তু, এই দুটি সংগঠন ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে বড় সহায়ক হয়ে ওঠে। ধর্মভিত্তিক দুটি আলাদা সংগঠনের ছত্রচ্ছায়ায় নিজেদের

বিশ্বাসের মূলও গড়ে ওঠে ধর্মীয় ভাবাপন্নতার মধ্য দিয়ে। সেজন্য দেখা যায় যখন ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত হয়, তখন দেশ বিভাগ হয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে
পাকিস্তান ছিল ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রশ্নে অন্তঃসারশূন্য। ইসলাম ধর্মের মুখোশ পরা ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসকবৃন্দ। ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় থাকার নিরন্তর প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয় পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী। বর্তমান বাংলাদেশ তখন অসহায় পূর্ব পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তান বাংলাদেশের জন্য শোষণযন্ত্রে পরিণত হয়। শোষিত বাংলাদেশ তখন বিবর্ণ। ইসলামি প্রজাতন্ত্রের নামে চলে ভাষাগত এবং সংস্কৃতিগত আগ্রাসন। ধর্মের দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রভাষা শুধু উর্দু করা হয়। ইসলামি সংস্কৃতির বিকাশের কথা বলে রবীন্দ্রনাথের গান নিষিদ্ধ করা হয়, এমন কি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা থেকে কিছু কিছু শব্দ (হিন্দুয়ানি শব্দ উল্লেখ করে) সংশোধন করার অপচেষ্টাও চলে। -সময়ে ইংরেজি শিক্ষা আর পাশ্চাত্য দর্শনের প্রভাবে বাংলায় গড়ে ওঠা সমাজব্যবস্থায় নারীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকে। কিন্তু পাশ্চাত্য শিক্ষা-দর্শন যেহেতু সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছয়নি তাই খুব অল্প কিছু পরিবারের নারীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে শুরু করে। ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার অবরুদ্ধ নারীজীবনের মুক্তির সূত্রপাত হয়। সেই বিকাশ পাকিস্তান আমল পর্যন্ত হয়েছে সীমিত পর্যায়ে
পাকিস্তান শাসনামলে ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতাকে উৎসাহিত করা হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের বুলিসর্বস্ব ইসলামি প্রজাতন্ত্রের যারা স্বপ্নদ্রষ্টা তাদের অন্যতম ছিলেন মুহম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনি কোনোদিন নামাজ পড়তেন না, রোজা রাখতেন না, প্রচুর মদ পান করতেন। একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাকে খুব জোর করেছিল মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য। যে মানুষটি ধর্মীয় কোনো অনুশাসন মানতেন না, অথচ ইসলামি প্রজাতন্ত্রের কথা বলতেন সেই মানুষটি যে কখনোই ইসলামের মানুষ নন সে-কথা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। ধর্মকে রাষ্ট্রক্ষমতার জন্য ব্যবহার না করা হয় সেই চেষ্টাও হয়েছে। তবে সেই চেষ্টা অধিকাংশ সময়েই ছিল খুবই ক্ষীণ। ১৯৪৯ সালেপূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগপ্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান সরকারের প্রথম বিরোধী দল হিসেবে এই দলটি কাজ করে। যখন পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী ধর্মের বাতাবরণে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে মুসলমানদের ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সমর্থন আদায় করতে ব্যস্ত তখন ১৯৫৫ সালেপূর্র্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগদলের নাম থেকেমুসলিমশব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক দল গঠনে প্রয়াসী হয়
কখনও ভাষা প্রশ্নে, কখনও শিক্ষা প্রশ্নে, কখনও স্বাধিকার প্রশ্নে, কখনও স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে, কখনও স্বাধীনতা প্রশ্নে বাংলা ভূখণ্ডে যে আন্দোলনগুলো হয়েছিল সেগুলোতে
 বাংলার সচেতন নারীসমাজ সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে। পাকিস্তান বিরোধী অনেক আন্দোলনে যুক্ত হওয়া নারীদের আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি কখনও। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে যে কয়েকটি ইতিবাচক উল্লেখযোগ্য কাজ হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নারীমুক্তি। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ভাবনা ছিল নারী-পুরুষ সমাজের দুটি চাকা। একটি চাকাকে অবহেলা করে সমাজ ভালোভাবে এগিয়ে যেতে পারে না। তার সেই চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রশ্নে অনেকখানি সচেতনতার পরিচয় দিয়েছে। সম্পদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই সেই সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে
পাকিস্তানি শাসকের নগ্নভাবে ধর্মকে ব্যবহারের চেষ্টার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শুধু তাই নয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই আদর্শকে বাস্তবে রূপ দিতেও সচেষ্ট হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশকে সাংবিধানিকভাবে ধর্ম-নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ধর্মকে যাতে করে ক্ষমতাসীন হওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা না যায় সেজন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে চেষ্টা করেছিলেন সে চেষ্টা তাকে মেরে ফেলার মধ্য দিয়ে ভূ-লুণ্ঠিত হয়। সাতচল্লিশে দেশ-বিভাগের সময়ে ধর্মকে ব্যবহার করেছিল পাকিস্তান সরকার। সেই সরকারের অনুসারী সংগঠন জামায়াতে ইসলাম। স্বাধীনতাযুদ্ধে জামায়াতে ইসলাম বাংলাদেশের শত্রশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর তাদের বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। জামায়াতে ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করার জন্য আবার সংগঠিত হতে শুরু করে। জামায়াতে ইসলাম প্রত্যক্ষভাবে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি শুরু করলেও অন্যান্য দলগুলোও যে ধর্মকে ব্যবহার করেনি তা কিন্তু নয়। বাংলাদেশে ধর্মকে রাষ্ট্রের জন্য ব্যবহার করার সবচেয়ে ক্ষতিকর কাজটি করেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তার পোশাক-পরিচ্ছদ কিংবা দৈনন্দিন জীবনে ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিচয় না থাকলেও তিনি রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ইসলামকেরাষ্ট্রধর্মহিসেবে ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতেধর্মব্যবহারের পথ সম্প্রসারিত হয়
ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’Ñ -চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষের সংখ্যা এখনও অনেক কম। বিজ্ঞানমনস্ক প্রগতিশীল সমাজ গঠনের চেষ্টাও আমাদের দেশে খুব বেশি হয়নি। আমাদের দেশে ধার্মিকের চেয়ে ধর্মভীরু মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে ধর্মীয় আবেগকে সহজেই ধর্মীয় উন্মাদনায় রূপ দেওয়া যায়। আবার যারা ধার্মিক তাদের মধ্যে একপেশে শিক্ষা থাকার কারণে তারাও ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলো বর্তমানে ভোটের কথা বিবেচনা করেই বিভিন্ন মত দেন, পক্ষ নেন। ধর্মীয় সংগঠনগুলোও ক্ষমতায় যাওয়ার মনোবাসনা থেকে প্রত্যক্ষ ধর্মনির্ভর নয় এমন দলগুলোর সাথে জোটবদ্ধ হয়। প্রত্যক্ষ ধর্ম- নির্ভর নয় এমন বড় বড় দলগুলোকেও কখনও ধর্মনিরপেক্ষ হতে দেখা যায় না। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষেতার কথা মৌখিকভাবে বলে; চেতনায় ধারণ করে না। সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ করার কথা বললেও রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম কথাটি বাদ দিতে পারেনি। অনেক কৌশলে দুকূল রাখার চেষ্টা করলেও দেশবাসীর বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনে ব্যর্থ হয়েছে। তারা যদি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে এবং আদর্শে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করত তাহলে সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হতে বাংলাদেশের কোনো বাধা ছিল না। এই কাজটি আওয়ামী লীগ করতে চায়নি মূলত ভোটারদের কথা ভেবে। বর্তমানে বিএনপির এমন অবস্থা যে জামায়াতের সাথে তাদের মিশে যাওয়ার মতো অবস্থা। জামায়াতকে সাথে রাখতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে যে সকল মত দিচ্ছে তাতে করে তারা যতখানি বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে উৎকণ্ঠিত তার চেয়ে জামায়াতকে বাঁচিয়ে দিতে চায়, সেটাই অধিক প্রতিপন্ন হচ্ছে
জামায়াতে ইসলাম গঠনতন্ত্র থেকে আল্লাহর নাম পর্যন্ত বাদ দিয়েছে। দলটির নামের মধ্যে ইসলাম শব্দটি ব্যবহার করে ধর্মভীরু মানুষকে নিজেদের দলের দিকে টানার একটি অপচেষ্টা রয়েছে। কার্যত তারা পাকিস্তানিদের মতোই ধর্মকে ক্ষমতায় যাওয়ার একটি অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। যে দলটি ক্ষমতাকে বাঁচিয়ে রাখতে স্রষ্টার নাম বাদ দিতে পারে সে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আর কি করতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না
ধর্মকে ব্যবহার করে -পর্যন্ত যতগুলো দাঙ্গা হয়েছে, নৃশংসতা হয়েছে, মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে তার মূলেই রয়েছে ধর্ম-বিজ্ঞান-দর্শন সম্পর্কে অজ্ঞতা। সকল ধর্মের মূল প্রবাহ যদি হয় শান্তি তাহলে অশান্তি সৃষ্টি করার জন্য ক্রমাগত রক্তপাতের ইতিহাস দীর্ঘ হচ্ছে
কেন ? ইসলাম ধর্মের উদারতা, মানবিকতা গ্রন্থে যতখানি রয়েছে, বাস্তবে ততখানি না থাকার কারণও হচ্ছে অজ্ঞতা। বর্তমানে হেফাজতে ইসলামের নামে একটি সংগঠন ইসলাম ধর্মকে হেফাজত করার জন্য যে ১৩দফা দাবি উত্থাপন করেছে তা প্রয়োগ করা কতখানি অবাস্তব সেই ধারণা তাদের মধ্যে নেই। তারা যে একটি ভ্রান্তির মধ্যে পতিত সেই দায় শুধু তাদের দিলে চলবে না। তাদের বিভ্রান্ত করে রাখার কাজটি নেপথ্যে সরকার-পরম্পরায় সকল বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন সকল রাজনৈতিক দলগুলোই করে আসছে। কওমি মাদ্রাসা নামে আমাদের দেশে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে সেখানে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-দর্শন-সমাজ-সভ্যতা-শিল্প কোনো কিছু সম্পর্কেই শেখানো হয় না। তারা একুশ শতকের আলো-বাতাসে বেড়ে উঠলেও তাদের চেতনা একুশ শতকীয় নয়। বাংলার আধুনিক শিক্ষা মুসলমানদের ধর্মকে যেভাবে গ্রহণ করতে শিখিয়েছে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পক্ষে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আমাদের দেশে এখনও প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা খুবই নগণ্য। ফলে হেফাজতে ইসলামের জন্য তাদের এক রকম মায়াকান্না রয়েছে। সেই মায়াকান্না যে অসার সেটা তাদের কাছে প্রতীয়মান নয়। অন্যদিকে রাজনৈতিকদলগুলোও নিজেদের সুবিধা পাওয়ার জন্য তাদের ব্যবহার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জামায়াত-বিএনপি যেভাবে হেফাজতে ইসলামের সাথে যুক্ত হচ্ছে তাতে করে মনে করাটা অমূলক নয় যে জামায়াত-বিএনপির নেপথ্য চালিত সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। তা নাহলে দলের চেয়ারপারসন একজন মহিলা হওয়ার পর সেই দলটি কীভাবে হেফাজতে ইসলামে সমর্থন করে। হেফাজতে ইসলাম রাজনৈতিক দল নয় বললেও দলটি সেরকমই কিনা সেই প্রশ্নও দেখা দিয়েছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। ধর্মভিত্তিক অনেকগুলো রাজনৈতিক সংগঠন সক্রিয় রয়েছে। যাদের একটি অন্যটির নীতি আদর্শ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করছে। যেমন জামায়াতে ইসলামকে জঙ্গীবাদী সংগঠন বলে উল্লেখ করেছে সম্মিলিত ইসলামী ঐক্যজোট। ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন হওয়ার হীনরাজনীতি যখন চলছে তখন নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন বলে হেফাজতে ইসলাম যেসকল দাবি নিয়ে দেশ অচল করার হুমকি প্রদর্শন করছে, কোমলমতি শিশু-কিশোরদের নিয়ে এসে ঢাকায় উপস্থিতির সংখ্যা বৃদ্ধি করছে, তার মধ্য দিয়ে যে বার্তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে তার পরিণতি দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিকর। হেফাজতে ইসলাম যে দাবিগুলো উত্থাপন করেছে তার মধ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ বন্ধের কথা বলা হয়েছে। অবাধ বিচরণ কথাটির ব্যাখ্যা না থাকবার কারণে অর্থটি পরিষ্কার হয় না। দেশে বর্তমানে নারীদের ধর্মীয় পোশাক পরিধানে কোথাও কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।বিচরণশব্দটিকে যদি চলাফেরা অর্থে গ্রহণ করা যায় তাহলে সেখানেও নারী-পুরুষ অবাধ নয়। তারপরও হেফাজতে ইসলামের নারীবিদ্বেষপ্রসূত দফা উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে নারীদের সঙ্গে পুরুষের যদি কোনো বৈষম্য সৃষ্টির অপতৎপরতা থাকে তা কোনোদিনই বাংলার প্রগতিভাবনার কোনো মানুষই মেনে নেবে না। হেফাজতে ইসলামের যারা কর্মী অথবা সমর্থক তারা মূলত শিক্ষার সীমাবদ্ধতাজনিত কারণে নিজেরাই বিভ্রান্ত অথবা সরকারবিরোধীদের ভিন্ন নামে অন্য একটি সংগঠন। ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতির চেষ্টা যতই করা হোক তা -ভূখণ্ডে আর বাস্তবায়িত হবে না। আমাদের দেশে নারীসমাজের যে মুক্তি ঘটেছে তাকেও আর অবরুদ্ধ করা সম্ভব হবে না
 লেখক শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

No comments:

Post a Comment